আয়াতের আর্তনাদ: “বাবা, তুমি কেন ফিরে আসো না?”
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের প্রতিটি প্রান্তে। কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল লাখো শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ। প্রতিটি শহর, প্রতিটি মোড় যেন একেকটি যুদ্ধক্ষেত্র। এরই মাঝে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডে সেদিন সন্ধ্যায় ঘটেছিল আরেকটি নীরব বিপ্লবের গল্প, যা কোনো পোস্টারে লেখা থাকবে না, কোনো স্লোগানে ধ্বনিত হবে না—তুহিন আহমেদের নিস্তব্ধ আত্মত্যাগ।

শহীদ রাজমিস্ত্রী তুহিন আহমেদ
তুহিন আহমেদ, এক সাধারণ রাজমিস্ত্রি। সংসারের চাকা চলমান রাখতে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে কাজে বের হোন, ফিরে আসেন গভীর রাতে। তার জীবন ছিল সেই নীরব সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, যা প্রতিদিনই দেশের হাজারো শ্রমজীবী মানুষ করে থাকে। কিন্তু সেদিন, ২০ জুলাই সন্ধ্যায়, তার সেই প্রতিদিনের পথচলা আর কখনো শেষ হলো না। কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন ২৮ বছর বয়সী তুহিন, হাতে ছিল সেদিনের মজুরির টুকরো টাকাগুলো। চারপাশে তখন বিপ্লবের স্রোত, ছাত্রদের স্লোগানে মুখরিত নারায়ণগঞ্জের রাজপথ। তুহিন জানতেন না, সেই স্লোগানমুখর উত্তাল জনতার গণতান্ত্রিক দাবীর কফিনে আরেকটা নামের তালিকায় তাকে যুক্ত করবে– পতিত স্বৈরাচার।
কোথা থেকে যেন হঠাৎ অপ্রস্তুত গুলি ছুটে এলো, সেই বিক্ষুব্ধ জনতার ভিড়ে নির্বিচারে ছুটে চললো তাণ্ডবের মতো। সেই অমানবিক তান্ডবের একটা বুলেট এসে বিঁধল তুহিনের তলপেটে, এক নিষ্ঠুর বুলেট! যেন তার সমস্ত স্বপ্নকে মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন করে দিল এক ভিত্তিহীন তাসের ঘরের মতো। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল, কিন্তু নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে সিঙ্গাইর—এই ছুটোছুটির মাঝেই নিঃশেষ হয়ে গেল তার জীবন। হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকা তুহিনের নিথর দেহটা যেন হয়ে উঠেছিল এই বিপ্লবের এক নীরব প্রশ্ন- “আমি কী দোষ করেছিলাম?”
সেদিন, তুহিনের স্ত্রী রিয়া শেখ তার বাবার বাড়িতে আটকে ছিলেন। দূরপাল্লার বাস বন্ধ, কারফিউর কারণে স্বামীর কাছে পৌঁছাতে পারলেন না। মোবাইলের অপরিচিত এক নম্বর থেকে যখন জানতে পারলেন তার স্বামী গুলিবিদ্ধ, তখনও ভাবেননি এটাই তাদের শেষ কথা। তুহিনের মৃত্যু তার পরিবারের কপালে লিখে গেলো এক অজানা অন্ধকারের গল্প। তিন বছরের শিশু আয়াত, যে এখনো বোঝে না তার বাবা আর কোনো দিন ফিরবে না। সে জানে, তার বাবা কবরে শুয়ে আছে, কাউকে পেলেই বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন অপেক্ষায় আছে তার বাবা আবার ফিরে আসবে। হয়ত কখনো ঘুম কেটে গেলে বাবা কবর থেকে উঠে এসে তাকে আবারো কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু একে দিবে!
রিয়া আহমেদ শয্যাশায়ী, চোখে ঘুম নেই, শুধুই চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে সদ্য খালি হওয়া বুক, চোখের গোড়ায় যেনো অসীম আধারের কালিমা জেকে বসেছে। বারবার বলছেন, “আমার স্বামী তো রাজনীতি করতো না, তাহলে কেন তাকে গুলি করা হলো?” একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি চলে যাওয়ায় ঋণের বোঝা, সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার চিন্তা তাকে গ্রাস করে ফেলছে। সাত বছরের সংসার, যা ছিল এক আকাশ ভালোবাসা আর টিকে থাকার নিষ্ঠুরতার সাথে সংগ্রামের মিশেল, আজ তা শুধুই স্মৃতি, শুধুই স্বপ্ন, শুধুই ইতিহাস। অপমৃত্যু কি ভুলে যাওয়া যায় সহজে? আয়াত আর রিয়াও হয়ত পারবে না, তুহিনের স্মৃতি তাদের স্মৃতি খুবলে ক্লান্ত করে যাবে দিনের পর দিন।
এই বিপ্লবের পথে তুহিন এক সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন হারালেও, তার মৃত্যু এক অসহায় পরিবারের জন্য এক সমুদ্র ক্ষত রেখে গেল। যে ক্ষত আজও রয়ে গেছে একটি ছোট্ট শিশুর মনে, যে তার বাবাকে ফিরে পেতে চায়। আয়াতের সেই নিঃশব্দ আর্তি, “বাবা, তুমি কেন ফিরে আসো না?” যেন আকাশের বুকে লেখা এক চিরন্তন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
২০২৪ সালের সেই ছাত্র-জনতার বিপ্লবে হাজারো স্লোগান উঠেছিল, কিন্তু তুহিনের মৃত্যুর পরে সেই স্লোগানগুলোর মধ্যে আর্তনাদ হয়ে গিয়েছিল একটি প্রশ্ন—“এই সহিংসতার মূল্য কী? জীবনের চাইতে ক্ষমতাই বড়?” তুহিনের মৃত্যু কি শুধুই একটি সংখ্যা হয়ে যাবে? তার ছোট্ট ছেলে আয়াত, যাকে এখনো বোঝাতে পারেনি কেউ যে তার বাবা আর ফিরে আসবে না, সেই আক্ষেপ আমাদের মনকে নাড়া দেয়।
কোটা সংস্কারের এই আন্দোলন বহু পরিবর্তন এনেছে, কিন্তু তুহিনের মতো নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু আমাদের মানবতার সামনে এক কঠিন প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। এই বিপ্লবের ইতিহাসে তুহিন আহমেদের নাম হয়তো কখনো লেখা হবে না, কিন্তু তার আত্মত্যাগ চিরকাল মনে করিয়ে দেবে আমাদের সেই দিনগুলোর নিষ্ঠুরতার কথা, যেখানে জীবন যেন একেবারে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতালোভী এক রক্তচোষা এক রাক্ষসের হাতে অকালেই ঝড়ে গিয়েছিল একটি জীবন, নিরুপায় করে দিয়েছিলো এক স্ত্রীকে আর পিতা হারানোর আজন্ম যন্ত্রনার কুপে নিক্ষেপ করেছিলো ছোট্ট আয়াতকে।
তুহিনের পরিবার আজও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে—কেন? এর দায় কার? কেউ জানে না, শুধু রয়ে গেছে এক অনন্ত শূন্যতা, আর একটি অবুঝ কোলের প্রশ্ন, “বাবা, তুমি কেন ফিরে আসো না?”
সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লেখাটি লিখেছেন –ফয়জুর রহমান সজীব, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়