হেলিকপ্টার দেখতে গিয়ে গুলিতে শহীদ সুমাইয়া

মেয়েটির নাম সুমাইয়া আক্তার। ২০০৫ সালের ৭ নভেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের আলিমাবাদ চরন্দপুর এলাকার সেলিম মাতুববর ও আসমা বেগমের ঘরে জন্ম নেয় এই ক্ষণজন্মা সূর্যকন্যা। পরিবারের তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন সুমাইয়া।
অভাবের সংসার। তার উপর স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানসহ মোট সাতটি মুখের দুইবেলা খাবার যোগান দিতে হবে বলে সেলিম মাতুব্বর সপরিবারে পাড়ি জমান নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর। সেখানে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরী নেন তিনি। আর তার স্ত্রী আসমা খাতুন একটি কার্টন ফ্যাক্টরীতে চাকরী শুরু করেন। সুমাইয়া তখন মাত্র সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। কিন্তু ভাগ্য গরীবের জন্য সবসময় সহায় হয় না। গত কোভিড মহামারীর সময়ে মারা যান সুমাইয়ার পিতা সেলিম মাতুব্বর।
সুমাইয়া তখন ১৬-১৭ বছর বয়স। পরিবারের সহযোগিতার জন্য সুমাইয়া আক্তার চাকরী শুরু করেন কাঁচপুরের এক পোশাক কারখানায়। লক্ষ্য জীবনে একটু অভাব থেকে মুক্তি পাওয়া। সেখানেই সুমাইয়া আক্তারের সাথে প্রণয় গড়ে ওঠে তারই সহকর্মী জাহিদ হোসেনের সাথে। এ যেন অতঃপর সুখের আলোর এক ক্ষিণ বিচ্ছুরণ। কিছুদিন প্রেমের সম্পর্কের পরেই তাদের প্রণয়ের পরিণয় হয় বিয়ের মাধ্যমে। গত দেড় বছর পূর্বে বিয়ে করেন সুমাইয়া আর জাহিদ।
এরপরের সময়টি যেন সাধ্যের মধ্যে পাওয়া একটা সুখের জীবন। সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুরের ভাড়া বাসায় একটা ছোট টোনা-টুনির ভালোবাসার সংসার। সেই ভালোবাসার সংসারে আরো সুখ নিয়ে আসে যেন একটা সংবাদ। সুমাইয়া আক্তার অন্তঃস্বত্ত্বা। নতুন একজন পৃথিবীতে আসছে এই সংবাদ পেয়ে চাকরী ছেড়ে দেন সুমাইয়া। চলে যান শশুড়বাড়ি কুমিল্লায়।
সেখানেই ১২ মে ২০২৪-এ পৃথিবীতে আসে জাহিদ ও সুমাইয়ার ছোট্ট পরী সুয়াইবা। সুয়াইবা ভূমিষ্ট হবার পরে কিছুটা অসুস্থ থাকায় সুমাইয়া আক্তার তার মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে আসেন তার মা আসমা বেগমের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় ছয়তলা ভবনে।
কিন্তু অভাগার ভাগ্যে সুখ স্থায়ী হয় না। হঠাৎ দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকে। অধিকার চেয়ে ছাত্রদের যৌক্তিক দাবী মেনে না নিয়ে বরং তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার শুরু করে হামলা, আটক ও নির্বিচারে হত্যা। প্রতিবাদে ছাত্র জনতা রাস্তায় নেমে আসে। লাগাতার অন্যায়ের প্রতিরোধের চাপে স্বৈরাচার অবৈধ সরকার ১৯ জুলাই সারাদেশে কারফিউ জারি করে। কিন্তু ছাত্র জনতা কারফিউতে দমে যাবার পাত্র নয়। তারা যে এবার হয় মরতে নয়তো অধিকার আদায়ের প্রতিজ্ঞায় ঘর ছেড়েছে। কারফিউ এর মধ্যেও বিভিন্নস্থানে আন্দোলন চলমান থাকে। এমনই এক দিন ছিলো ২০ জুলাই ২০২৪।
২০ জুলাই, শনিবার। মায়ের ছয়তলা বাসায় আড়াই বছরের মেয়ে সুয়াইবাকে ঘুম পাড়াচ্ছেন সুমাইয়া আক্তার। অদূরেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল ও আশেপাশের এলাকায় স্বৈরাচার পরিচালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ চলছে। সুমাইয়ার মা নিজ বাসার বারান্দা থেকে দাড়িয়ে দেখছিলেন সবকিছু। এরমধ্যে খুব নিচ দিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ে যায়। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে ২০ বছর বয়েসী সুমাইয়া আক্তারও চলে আসে বারান্দায়। আড়াই মাস আগে সিজার হওয়ায় এখনো তার পেটের সেলাই এর শুকিয়ে যায় নি। কিছুটা দুর্বল শরীর কিন্তু কৌতুহলী সুমাইয়া এসে বারান্দায় দাড়ায়। ততক্ষণে হেলিকপ্টারটি চলে গেছে।
সুমাইয়া বারান্দার সামনের দিকে আর তার মা একটু পেছনে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলেন। ঠিক ১-২ মিনিট পরে আবারও হেলিকপ্টারটি উড়ে আসে। সুমাইয়াদের বারান্দার একদম কাছে থেকে উড়ে যায় হেলিকপ্টারটি। আচমকা এক বিকট শব্দ। সুমাইয়ার মা লক্ষ্য করেন তার মেয়ে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছেন। তিনি সাথে সাথে সুমাইয়াকে ধরে ফেলেন। সুমাইয়ার মা দেখলেন তার মেয়ে কোনো কথা বলছে না। কপাল থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছে ফ্লোরে। সাথে সাথে সুমাইয়ার মা আসমা বেগম চিৎকার করে কান্না করে ওঠেন। তার চিৎকারে ঘরের সবাই ছুটে এসে দেখে সুমাইয়া আক্তার রক্তাক্ত পড়ে আছে।

ততক্ষণে আসেপাশের প্রতিবেশীরাও ছুটে আসেন। সুমাইয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান সুমাইয়া আক্তার আর নেই।

সুমাইয়ার মা আসমা বেগম ঘটনার বর্ণনা করছিলেন এভাবে, ‘অনেক নিচ দিয়া হেলিকপ্টার চক্কর মারতাছে। সড়কে (অদূরেই) পুলিশের গোলাগুলি চলতাছে। এ সময় আমি বারান্দায় খাড়াইয়া এইগুলো দেখতেছিলাম। সবাই দেখতাছে, আমিও হেলিকপ্টার দেখমু বোইলা আমার মাইয়াডাও বারান্দায় আইসা দাঁড়াইলো হেলিকপ্টার দেখতে। আমাগো বারান্দার কাছ দিয়ে হেলিকাপ্টার উইড়া গেলো। সড়কে (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে) পুলিশের গোলাগুলি চলতাছে। আমার আড়াই মাসের নাতনীডারে শোয়াইয়া আমার লগে আইসা খাড়াইলো আমার মাইয়া। খাড়ানোর ১-২ মিনিটের মধ্যেই মাইয়াডা পোইরা যাইতাছে দেইখা আমি ধরলাম। লগে লগে আমার হাতেই লুটাইয়া পড়ল। আমি অবাক অইয়া গেলাম। মাইয়ার কপালেত্তে রক্ত বাইর অইয়া আমার হাত ভাইস্যা গেলোগা। আমি চিল্লান দিলাম। পোলারা আইয়া আমার মাইয়ারে ডাক দিল। আমার মাইয়া আর কথা কোইলোনা। আমাগো চিৎকারে পাশের মানুষ আইলো। সবাইরে কোইলাম, টেকা লাগলে আমি দিমু। আমার নাতনির লাইগা আমার মাইয়ারে বাঁচান লাগবো। হাসপাতালে লইয়া যাও। সবাই হাসপাতালে নিল। কিন্তু আমার মাইয়ারে আর জীবিত পাইলাম না।’

সুমাইয়া আক্তারের মরদেহ ওইদিনই গ্রামের বাড়ি দাফনের জন্য নিয়ে যেতে চায় তার পরিবার। কিন্তু স্বৈরাচারদের শোষনের ভয়ে ওই রাতে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় দাফন করা হয় মাত্র ২০ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া অমর সন্তান শহীদ সুমাইয়া আক্তার।
হেলিকপ্টার দিয়ে ছোঁড়া সেই গুলিটি সুমাইয়ার মায়ের বাসার সেই বারান্দার রেলিংয়ের এসএস পাইপ ভেদ করে লেগেছিলো সুমাইয়ার মাথার বাম পাশে। সেই রেলিংও আছে। আছেন প্রত্যক্ষদর্শীরাও। হত্যাকারীরাও আছে। শুধু নেই দুইচোখ স্বপ্নভরা, অভাব থেকে মুক্তি চাওয়া মাত্র ২০ বছর বয়েসী সুমাইয়া আক্তার যার হয়তো আজকে তার ছোট্ট সুয়াইবাকে কোলে করে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশকে দেখিয়ে বলার কথা ছিলো, “ দেখ মা! এই যে আমাদের দেশ। এইটা সত্যিই এখন আমাদের দেশ। কারো বাপের না।”
ছোট অবুঝ বাচ্চা মেয়ে সুয়াইবা। তবুও জানিনা কেন, তার সামনে বসে তার বীর শহীদ মা সুমাইয়া আক্তারের কথা বললে নিরবে মেয়েটার চোখ থেকে জল বেয়ে পড়ে।

আড়াই মাসের মেয়ে রেখে শহীদ হয়েছেন সুমাইয়া আক্তার। ।

সংবাদপত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুলাই আর্কাইভের জন্য এটি লিখেছেন- সৌমিক ফারুকী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার ও মিউজিশিয়ান।

Loading

Scroll to Top