জুলাই অভ্যুত্থানের টাইমলাইন
নোট: নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন ও ব্যক্তিগত নোট থেকে এই টাইমলাইনটি তৈরী করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচী, বিভিন্ন দফা, সরকারপক্ষের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ইত্যাদি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। অভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার প্রতিটি ঘটনাই গুরুত্ববহ, যেহেতু এটি একটি সংক্ষিপ্ত আয়তনের টাইমলাইন, তাই শুধু আলোচিত কিছু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। কোনোরূপ ডিটেইলসে কিংবা বিশ্লেষণে যাওয়া হয়নি। এছাড়াও
স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, বিভিন্ন দিনে শহীদের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তা কেবল পত্রিকায় উল্লিখিত সংখ্যামাত্র, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। জুলাই আর্কাইভ শীঘ্রই অভ্যুত্থানের দিনিলিপি প্রকাশ করবে, যেখানে প্রতিদিনের বর্ণনা আরো ব্যাপক আকারে পাওয়া যাবে। – দেওয়ান তাহমিদ, চিফ কো-অর্ডিনেটর, জুলাই আর্কাইভ
৫ জুন, ২০২৪, সোমবার
সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান। এই রায়ের ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ায় আর বাধা থাকল না।
৬ জুন, ২০২৪, মঙ্গলবার
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) পুনর্বহালে আদালতের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ। ‘সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটাপদ্ধতি পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে’ এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
৯ জুন, ২০২৪, শুক্রবার
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন তাঁরা। একই দাবিতে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেন। বিক্ষোভ শেষে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদল সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর স্মারকলিপি দিতে যায়।
এদিকে কোটা বাতিল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৪ জুলাই দিন নির্ধারণ করা হয়।
১ জুলাই, সোমবার
কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান জানানো হয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। কর্মসূচির মধ্যে ছিল, পরদিন মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে গণপদযাত্রা শুরু। আর বুধ ও বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যে একত্র হবেন বলে জানানো হয়।
সমাবেশে তারা ৪ দফা দাবি করে:
১.২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকুরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে।
২. ১৮’ এর পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকুরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
৩.সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে।
৪.দূর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।


২ জুলাই, মঙ্গলবার
সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ হয়। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ চাকরি বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য সংরক্ষিত ছিল। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, এটা বৈষম্যমূল এবং মেধাভিত্তিক নিয়োগের জন্য ক্ষতিকর।
আন্দোলনকারীরা এই দিন বেলা পৌনে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল করে নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও বাটা সিগন্যাল মোড় ঘুরে শাহবাগে গিয়ে থামে। সেখানে তাঁরা এক ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। একই দিন বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা-আরিচা ২০ মিনিটের জন্য অবরোধ করেন।
৩ জুলাই, বুধবার
এই দিন আন্দোলনকারীরা ঢাকার শাহবাগ মোড় দেড় ঘণ্টার মতো অবরোধ করে রাখেন। একই দাবিতে আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবরোধ করেন। এর মধ্যে ময়মনসিংহে রেললাইনে ট্রেন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন। বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়।
৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার
সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে স্থগিত করেনি। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ ‘নট টুডে’ বলে আদেশ দেন। আর্টনি জেনারেলের উদ্দেশে আপিল বিভাগ বলেন, কোটা পদ্ধতি নিয়ে এত কিসের আন্দোলন? আন্দোলন করে কি সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করা যায়? পরের সপ্তাহে এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে বলে ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে জানানো হয়।
আপিল শুনানি হওয়ার কথা, এটিকে সামনে রেখে সকাল ১১টা থেকে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয় ঢাবি শিক্ষার্থীরা। কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের রায় না হওয়া পর্যন্ত একই স্থানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানিয়েছেন তারা। আগেরদিন শাহবাগে অনুষ্ঠিত অবস্থান কর্মসূচি থেকে এই ঘোষণা আসে।
দুপুর ২টা থেকে ঢাবির প্রতিটি হল থেকেই শত শত শিক্ষার্থী কোটার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এসে জড়ো হন। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে মিছিল নিয়ে কলা ভবন, ভিসি চত্বর, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট ও মৎস্য ভবন এলাকা হয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান শুরু করলে পুরো এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ফলে শাহবাগকে সংযুক্তকারী প্রতিটি সড়কেই সৃষ্ট তীব্র যানজটের কারণে দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। বিকেল ৫টায় আন্দোলনকারীরা শাহবাগ ত্যাগ করলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হলের মূল ফটকে তালা দিয়ে রাখে ছাত্রলীগ। এতে আন্দোলনে যোগ দিতে চাওয়া শতাধিক শিক্ষার্থী হলের ভেতর আটকে পড়েন। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে তালা খুলে দেওয়া হয়। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, কবি জসীম উদ্দীন হল, বিজয় একাত্তর হলের মূল ফটকে চেয়ার-টেবিল নিয়ে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা অবস্থান নেয়। স্যার এ এফ রহমান হলে আন্দোলনে ডাকার জন্য শিক্ষার্থীদের মাইকিংয়ে বাধা দেয় ছাত্রলীগ। এদিকে শাহবাগে আন্দোলন চলাকালে নেতাকর্মীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছে ছাত্রলীগ। রাতে সমন্বয়ক সারজিস আলমকে ছাত্রলীগ হল থেকে বের করতে চাইলে শিখশার্থীরা তা রুখে দেয়।
আরো কিছু কর্মসূচি দেখা যায়, যেমন- রেললাইন অবরোধ বাকৃবি শিক্ষার্থীদের, সড়ক অবরোধ জবি শিক্ষার্থীদের, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ জাবি শিক্ষার্থীদের, কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় ববি শিক্ষার্থীরা: হাইকোর্টের আদেশের প্রতিবাদে গতকাল তৃতীয় দিনের মতো ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা, শাবিপ্রবিতে বিক্ষোভ। এ দিন শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ করে। আর ঢাকায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে ৫ ঘণ্টা। সমাবেশ থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
৫ জুলাই, শুক্রবার
ছুটির দিন শুক্রবারেও বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে সড়ক অবরোধ।
৬ জুলাই, শনিবার
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিনের মতোই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা পরদিন থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্র ধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। কর্মসূচির আওতায় রবিবার বিকাল ৩টা থেকে সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নেবেন শিক্ষার্থীরা।
৭ জুলাই, রোববার

বাংলা ব্লকেডের প্রথম দিন। স্থবির রাজধানী। দেশজুড়ে মহাসড়কে অবস্থান। অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা। আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন শেখ হাসিনার।
এই কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকা-সহ দেশের বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচির কারণে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। প্রায় ৫ ঘণ্টা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি রাস্তা অবরোধ শেষে রাত আটটার পর রাস্তা ছাড়েন আন্দোলনকারীরা।
সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নেয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামের ষোল শহর, জিইসি ও অক্সিজেন মোড়ে অবস্থান নেয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি এলাকায়। এছাড়াও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বন্ধ করে দেয় যান চলাচল।
৮ জুলাই, সোমবার
দ্বিতীয় দিনের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ৬৫ সদস্যের কমিটি গঠন। কমিটিতে সমন্বয়ক হিসেবে ২৩ জনের নাম আছে। অন্যরা সহসমন্বয়ক।
সমন্বয়ক হিসেবে যাদের নাম এসেছে:
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, মো. মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার, আব্দুল হান্নান মাসুদ, আদনান আবির, জামান মৃধা, মোহাম্মদ সোহাগ মিয়া, নুসরাত তাবাসসুম, রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, মুমতাহীনা মাহজাবিন মোহনা, আনিকা তাহসিনা, উমামা ফাতেমা, আলিফ হোসাইন ও কাউসার মিয়া।
- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিফ সোহেল,
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসেল আহমেদ,
- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদুল্লাহ আল গালিব,
- শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. তৌহিদ আহমেদ আশিক, এবং
- ইডেন মহিলা কলেজের সাবিনা ইয়াসমিন।
সহ-সমন্বয়ক হিসেবে যাদের নাম আসেঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফাত রশিদ, হাসিব আল ইসলাম, আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন, নিশিতা জামান নিহা, রেজোয়ান রিফাত, মেহেদী হাসান, মো. আবু সাঈদ, নুমান আহমাদ চৌধুরী, রিজভি আলম, সানজানা আফিফা অদিতি, ফাহিম শাহরিয়ার, গোলাম রাব্বি, কুররাতুল আন কানিজ, মিনহাজ ফাহিম, মো. মহিউদ্দিন, মেহেদী হাসান মুন্না, সরদার নাদিম সরকার শুভ, রিদুয়ান আহমেদ, নূরুল ইসলাম নাহিদ, রাইয়ান ফেরদৌস, সাব্বির উদ্দিন রিয়ন, হামজা মাহবুব, এবি যুবায়ের, তানজিলা তামিম হাপসা, বায়েজিদ হাসান, শাহেদ, মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ, দিলরুবা আক্তার পলি, ঈশী সরকার, ফাতিহা শারমিন এনি, সামিয়া আক্তার, মাইশা মালিহা, সাদিয়া হাসান লিজা, তারেক আদনান।
ঢাকার ১১টি স্থানে অবরোধ, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, ৩টি স্থানে রেলপথ অবরোধ এবং ৬টি মহাসড়ক অবরোধ। সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাসের দাবি।
সমন্বয়ক কমিটির সদস্য নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবির পরিবর্তে এক দফা দাবির কথা বলেন। দাবিটি হলো, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করা। নাহিদ এ সময় আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের এক দফা দাবি দিয়ে দিয়েছি, যেখানে আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই। এটা করার দায়িত্ব কেবল নির্বাহী বিভাগ ও সরকারের। ফলে বল এখন সরকারের কোর্টে। এখন আর আদালত দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। সরকারই ঠিক করতে পারে, এই আন্দোলনের গতিপথ কী হবে।’
৯ জুলাই, মঙ্গলবার
ব্লকেড না থাকলেও ছাত্র ধর্মঘট ও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি চলমান। অনলাইন ও অফলাইনে জনসংযোগ
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থীর আবেদন। শুনানি হবে পরদিন। অবশ্য ওই দুই শিক্ষার্থীর আবেদন করার সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা চার ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে আগের মতো অর্ধদিবস নয়, বরং সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
১০ জুলাই, বুধবার
বাংলা ব্লকেডের ৪র্থ দিন। রাজধানী ও মহাসড়কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করায় রাস্তা, মহাসড়ক ও রেলপথে যান চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ আপিল বিভাগের। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন রাখা হয়।
শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমরা এই সমাজের মানুষ, কিছু কথা বলতেই হয়। সেটি হচ্ছে যে একটা রায় হাইকোর্টে হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে। সেখানে তারা যেটা করেছে, এটা অ্যাপ্রিশিয়েট (প্রশংসা) করার মতো না। মনে হয়, তারা ভুল বুঝেই করেছে।, তিনি যোগ করেন, ‘আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটা আজকে না, আমি যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিলাম, তখন একটি মামলায় বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এটি সঠিক পদক্ষেপ না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বারবার বিভিন্ন পক্ষ আদালতে গেলে সেটা বাতিল বা স্থগিত করা হচ্ছে। পরে আবার হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা কি একমাস পরপর তাহলে রাস্তায় নামবো? তাই একবারেই এই সমস্যার সমাধান চাই”। তিনি আরো বলেন, “এখন যেহেতু রাস্তায় নেমেছি তাই এটার একটা স্থায়ী যৌক্তিক সমাধান হোক চাই। সেটা নির্বাহী বিভাগের পক্ষেই সম্ভব। জাতীয় সংসদে আইন পাস করে নতুন পরিপত্র করে এটা করতে পারে”
১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার
বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি চলমান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন।
এ দিন পুলিশের বাধার মুখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ পালন করেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশের হামলায় দেশের কয়েকটি স্থানে কমপক্ষে ৩০ জন আন্দোলনকারী আহত হওয়ার দাবী। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের দমন-পীড়নে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
১২ জুলাই, শুক্রবার
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। রেলপথ অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কুমিল্লায় কর্মসূচি চলাকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
শনিবার (১৩ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কর্মসূচি প্রকাশ করার ঘোষণা।
১৩ জুলাই, শনিবার
সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা। পরের দিন রোববার গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর এ স্মারকলিপি দেবেন আন্দোলনকারীরা।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের এখন কিছু করার নেই।
শিক্ষার্থীদের প্রতি ১০ নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। শনিবার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে ১০ নির্দেশনা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
১০ নির্দেশনা: ‘যেভাবে আন্দোলন পরিচালনা করবেন-
১. বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, জেলা ও মহানগরে যারা আন্দোলন সমন্বয় করছেন সবাই সংগঠিত হওয়ার জন্য আলাদা করে সমন্বয়ক কমিটি তৈরি করুন। দল, মত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ রাখুন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করুন এবং সবার আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। তবে আন্দোলনের স্বার্থে বিতর্কিত বা রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে এরকম কাউকে নেতৃত্ব পর্যায়ে রাখবেন না।
২. আন্দোলনকে কোনো একক বা মূল নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল করবেন না। সবসময় বিকল্প নেতৃত্ব প্রস্তুত রাখুন। প্রথম দিকের নেতৃত্বে ওপর ঝামেলা হলেও আন্দোলন স্তিমিত হবে না। নেতৃত্বে নতুন চেহারা আনার চেষ্টা করুন।
৩. ইন্টার্নালি সংগঠিত থাকুন, কিন্তু আন্দোলনকে কোনো সাংগঠনিক রূপ দিবেন না। কমিটিটা শুধু শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্র যাতে বজায় থাকে। তবে কোনো পক্ষ অনুপ্রবেশ করে যাতে স্যাবোটেজ করতে না পারে, এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। আন্দোলন সব সময় শান্তিপূর্ণ ও অহিংস হবে।
৪. যে স্থানে কর্মসূচি করবেন সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যোগাযোগ করতে চাইলে তাদের সঙ্গে কো-অপারেট করুন। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত আপনারাই নেবেন। কোনো ধরনের আপস করা যাবে না।
৫. সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করার চেষ্টা করুন। জেলা বা মহানগরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করুন এবং একসঙ্গে বড় জমায়েত করার চেষ্টা করুন।
৬. কারো ওপর কোনো আঘাত বা হুমকি আসলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করুন। ভয় পাবেন না, পিছিয়ে যাবেন না। সামনে এসে কথা বলুন। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই। আমাদের দাবি ও বক্তব্য সুস্পষ্ট এবং যৌক্তিক।
৭. বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে যুক্ত করুন। কর্মসূচিতে সাংস্কৃতিক আয়োজন রাখুন। জেলা ও মহানগরের নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কর্মসূচির আগে মাইকিং ও লিফলেটের মাধ্যমে ব্যাপক গণসংযোগ করুন। হলের রুমে রুমে, লাইব্রেরিতে প্রচার করুন।
৮. মিডিয়া ও সংবাদকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখুন। মিডিয়ার সামনে বুঝে শুনে কথা বলুন, যাতে মূল বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে। প্রোগ্রামে ও মিডিয়ায় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এরকম বক্তব্য বা স্লোগান দেবেন না।
৯. ঢাকার সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসূচি রাখার চেষ্টা করুন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানার যারা ব্যবহার করবেন তারা অবশ্যই ঢাকার সঙ্গে আলোচনা করে নেবেন।
১০. অর্থ সংগ্রহের জন্য সরাসরি ক্রাউড ফান্ডিং করুন। কোনো অনলাইন মিডিয়াম ব্যবহার করবেন না। অর্থের নিয়মিত হিসাব রাখুন এবং সমন্বয়ক টিমের কাছে হিসাব ক্লিয়ার (স্বচ্ছ) রাখুন। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নেবেন না। কারো কাছ থেকে বেশি অঙ্কের টাকা নেবেন না। রাজনৈতিক স্বার্থ আছে এরকম কারো কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা নেবেন না।
১৪ জুলাই, রোববার
গণপদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।
চীন সফর উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে ব্যাপক আকারে হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
পরে মধ্যরাতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবার বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ সময় আন্দোলনকারীরা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার” এবং কোথাও এটির সাথে “কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ কিংবা ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়।
১৫ জুলাই, সোমবার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব দেয়ার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এর পরে দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ দফায় দফায় হামলা চালায়। হামলায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাড়াও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, লাঠি, রড, জিআই পাইপসহ দেশি অস্ত্র। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন স্থানে পিস্তল নিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায় অন্তত ৫ অস্ত্রধারীকে। হামলায় শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসা নেন ২৯৭ জন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এমনকি ঢাকা মেডিকেলেও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ১৬ জুলাই বেলা ৩টায় সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
১৬ জুলাই, মঙ্গলবার
সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকার সমর্থকেরা। এতে নিহত হন ছয়জন। যার মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুজন এবং রংপুরে একজন শহীদ হন। রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার সচিত্র ছবি প্রকাশ।
ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ তছনছ-ভাঙচুর করে।
বিকেলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে। সবকিছুই মনে রাখা হবে এবং জবাব দেওয়া হবে। একটি ঘটনাও জবাব ছাড়া যাবে না। রাজাকারদের ফাঁদে পড়ে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে আমরা দেখে নেব, কত ধানে কত চাল হয়।’
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নতুন কর্মসূচি। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বুধবার গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করবেন তাঁরা।
সরকার বিকেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর ও রাজশাহীতে বিজিবি মোতায়েন করে। রাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
প্রথম শহীদের কাতারে নাম লেখান যারা-
শহীদ আবু সাঈদ: ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখ দুপুরে রংপুর শহর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) প্রধান ফটকের সামনে সমবেত হন। দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ অবস্থান নেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা ছিলেন পার্ক মোড়ের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২২) ছিলেন শিক্ষার্থীদের মিছিলের একেবারে সামনের দিকে। আবু সাঈদ এ সময় বুক চিতিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। এ সময় বিপরীত দিকে থাকা পুলিশ সদস্যদের ছুড়তে থাকা বুলেটের আঘাতে একপর্যায়ে বসে পড়েন আবু সাঈদ। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও প্রকাশের পর তা ব্যাপক তোল্পাড় তোলে সারাদেশে।

শহীদ ফারুক, ওয়াসিম, ফয়সাল: ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখ চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করার কথা ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। বেলা সাড়ে ৩টায় এই কর্মসূচি শুরুর আগেই স্টেশনে অবস্থান নেয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে আন্দোলনকারীরা খণ্ড খণ্ড জমায়েতে স্টেশনের দিকে আসতে থাকেন। ৩টার দিকে মুরাদপুর মোড়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও পাথর নিক্ষেপ। এ সময় অন্তত তিনজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গুলি ও ককটেলের আঘাতে নিহত হন ফারুক, ওয়াসিম ও ফয়সাল। এর মধ্যে মো. ফারুক (৩২) ছিলেন ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী, মো. ওয়াসিম (২২) চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ফয়সাল আহমেদ (২০) ছিলেন ওমর গণি এমইএস কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী।
মুরাদপুর মোড়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও পাথর নিক্ষেপ। এ সময় অন্তত তিনজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
শহীদ শাহজাহান, সবুজ আলী: ১৬ জুলাই ২০২৪ দুপুরে ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের কয়েকশ শিক্ষার্থী সায়েন্স ল্যাব মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে সায়েন্স ল্যাবের কাছে ঢাকা কলেজের সামনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে দেখা যায় রামদা, রড, লোহার পাইপ, বাঁশ-কাঠের লাঠি। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করছিলেন। একপর্যায়ে সরকার সমর্থক নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় নিহত হন মো. শাহজাহান (২৪) ও সবুজ আলী (২৫)। এর মধ্যে শাহজাহান ছিলেন একজন হকার, তিনি বলাকা সিনেমা হলের সামনে হকারি করতেন। আর সবুজ আলী ছিলেন ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী।
সায়েন্স ল্যাবের কাছে ঢাকা কলেজের সামনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে দেখা যায় রামদা, রড, লোহার পাইপ, বাঁশ-কাঠের লাঠি।
রাতে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবস্থাই পুরোপুরি বন্ধ করা হয়।
১৭ই জুলাই, বুধবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা।
ছুটির ঘোষণা সত্ত্বেও ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিন মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন।
রাত সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ। কোটা ইস্যুতে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের (যা ৭ আগস্ট দেওয়ার কথা ছিল) জন্য অপেক্ষা করার আহ্বান জানান। ছাত্রদের প্রতিশ্রুতি দেন যে আদালতের রায় তাদেরকে হতাশ করবে না।
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির প্রথম দিন। ‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ কমপ্লিট শাটডাউন বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। ঢাকা ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা, গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় এক দিনে কমপক্ষে ৪১ জন নিহত হন, যা বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ও ছাত্রলীগের লোকজন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে গুলি করে মারার মতো ঘটনাও ঘটে। শুধু উত্তরাতেই এক দিনে ১৯ জন নিহত।

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যাওয়ার প্রধান মহাসড়কের টোল প্লাজার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি সরকারি অফিস ভবনেও হামলা চালানো হয়, কার ও বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শহরের অন্যতম প্রধান অবকাঠামো মেট্রোরেল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ হয়, পরে হেলিকপ্টারে উদ্ধার।
সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন।
সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব রাখেন, কোটা বিষয়ে আদালতের শুনানি এগিয়ে আনার কথা বলেন। যদিও এর আগপর্যন্ত সরকারের ‘আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই’–এ রকম অবস্থান ছিল। সরকার যখন আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছিল তখনও রাজপথে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও দলীয় ক্যাডার বাহিনী আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকার আলোচনার কোনো পথ রাখেনি। তিনি বলেছেন, ‘যদি এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজপথ থেকে সরানো না হয়; যদি হল, ক্যাম্পাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দেওয়া হয়, যদি এখনো গুলি অব্যাহত থাকে, তাহলে সরকারকেই সম্পূর্ণ দায় নিতে হবে।’ আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘শুরুতে আমরাই বারবার সংলাপ চাচ্ছিলাম। খুন করে সেই পথ অবরুদ্ধ করেছে সরকার। সব বাহিনীকে নিরস্ত্র করুন, খুনগুলোর জন্য দায়ী সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলকে শাস্তির আওতায় আনুন, ক্যাম্পাসগুলো আমাদের হাতে ফিরিয়ে দিন।’ আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম লিখেছেন, ‘একদিকে গুলি আর লাশ, অন্যদিকে সংলাপ! আমার ভাইয়ের রক্তের ওপর দিয়ে কীভাবে সংলাপ হতে পারে।’
রাত ৯টার দিকে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও ক্যারিয়ারগুলোকে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। দেশে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট শুরু হয়। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ সরকারি কর্মকর্তারা মহাখালীর একটি ডেটা সেন্টারে আগুন লাগার ফলে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন।
১৯ জুলাই, শুক্রবার
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের প্রথম দিন ও কমপ্লিট শাটডাউনের দ্বিতীয় দিন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এদিন অন্তত ৭৫ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় জনসাধারণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন।
মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। গণপরিবহন কর্তৃপক্ষের ভবন ভাঙচুর।
নরসিংদীর একটি কারাগারে হামলা করে প্রায় ৯০০ বন্দিকে ছেড়ে দেয়া হয়। প্রায় ৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজারের বেশি রাউন্ড গোলাবারুদ লুট করা হয়।
বিকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম শ-খানেক মোটরসাইকেল নিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের পাল্টা হামলায় জাহাঙ্গীর আহত হন। জাহাঙ্গীরের এক সহযোগী জুয়েল নিহত হন। জুয়েলের লাশ ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় টানা তৃতীয় দিনের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখলে রাখেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন। ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় ৯ দফা দাবিতে কমপ্লিট শাটডাউন চলমান থাকার কথা জানান।
শিক্ষার্থীদের ৯ দফা –
১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
২. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রিপরিষদ ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
৩. ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র শহীদ হয়েছেন, সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে।
৫. যে পুলিশ সদস্যরা গুলি করেছেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ যেসব সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে, তাদের আটক করে এবং হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার দেখাতে হবে।
৬. দেশব্যাপী যেসব শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহীদ ও আহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৭. ঢাবি, জাবি, চবি, রাবিসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদকে কার্যকর করতে হবে।
৮. অবিলম্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলসমূহ খুলে দিতে হবে।
৯. যেসব ছাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের কোনো ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদ গুম।
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ ব্যবহার করে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
২০ জুলাই, শনিবার
কারফিউর প্রথম দিন। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের স্বিতীয় দিন ও কমপ্লিট শাটডাউনের তৃতীয় দিন।
দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন। সাধারণ ছুটি ঘোষণা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে শনিবার নিহত ২৬।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে।
১৯ জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে তার পরিবার। পরিবারের পক্ষ থেকে ২০ জুলাই ডিবি ও সিআইডি কার্যালয়ে গিয়ে নাহিদের খোঁজ মেলেনি। এদিকে নাহিদের খোঁজে ২০ জুলাই প্রথমে ডিবি কার্যালয় এবং পরে সিআইডি কার্যালয়ে যাওয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলামকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা একটি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন নাহিদের বাবা বদরুল ইসলাম। বদরুল ইসলাম পরে সংবাদমাধ্যমকে জানান যে সারজিস পরে তাকে ফোন করে জানিয়েছেন তারা বাড়ি পৌঁছেছেন।
আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলামের বৈঠক। এই সমন্বয়করা এঁকে বঈঠকের বইদলে দাবী পেশ আখ্যা দেন। আট দফা দাবি পেশ করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এই বৈঠক নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতভেদ।
এই ৮ দফায় যা আছে :
১ যে পুলিশ সদস্যরা আমাদের ভাইদের গুলি করে হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে। গ্রেপ্তার ও দ্রুত সময়ে বিচার করতে হবে। শহীদ ভাইদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা ও মাসিক ভাতা দিতে হবে।
২. পিতা-মাতার মতামতের ডিত্তিতে পরিবারের কমপক্ষে একজনকে সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনিকভাবে সিট দিতে হবে সন্ত্রাস কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে।
৩. সকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপসারণ করে আবাসিক হলগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অতিসত্তর খুলে দিতে হবে।
৪. ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃত্বে যারা নেতৃত্বে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের
অতর্কিত হামলা ও নৃশংসতা চালিয়েছে তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৫. ছাত্রলীগকে উস্কে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারের দায়িতৃপ্রাপ্ত যেসব ব্যক্তি রয়েছেন তাদেরকে আইনানুগ জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে ।
৬. যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নীরব ভূমিকার কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববদ্যালয়।
৭. কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব মামলা করা হয়েছে সেসব মামলা নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করতে হবে। ৮. আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে পাঠানো খুদে বার্তায় বলেন, ‘আমাদের কয়েকজন সমন্বয়ককে সরকারি বাহিনী হেফাজতে নিয়ে তাদের দিয়ে মনগড়া বক্তব্য তৈরি করে তা প্রচার করছে। আমাদের পূর্বঘোষিত নয় দফা দাবি বাস্তবায়ন হওয়ার আগপর্যন্ত কমপ্লিট শাটডাউন অব্যাহত থাকবে।’ অন্যদিকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় যে ৯ দফার খবর ছাপা হয়েছে, তা কোনো মহলের ছড়ানো গুজব। গণমাধ্যমের কাছে মুঠোফোনে পূর্বে গঠিত ৬৫ সমন্বয়ক টিমের মধ্যে ৬২ জন সমন্বয়কের নামে পাঠানো বিবৃতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা।
২১ জুলাই, রোববার
কারফিউর দ্বিতীয় দিন। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের তৃতীয় দিন ও কমপ্লিট শাটডাউনের চতুর্থ দিন।
কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানি, কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ নির্ধারণের আদেশ। তবে সরকার চাইলে বদলানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।
রাজধানীতে সংঘর্ষ অব্যহত। কয়েকটি স্থানে সড়ক অবরোধ। যাত্রাবাড়ি ও শনির আখড়ায় বিকাল পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের অবস্থান, পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত। নরসিংদীর মাধবদিতে কারফিউ ভেঙে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিক্ষোভ, অন্তত ৩ জন গুলিবদ্ধ হয়ে শহীদ। নারায়ণগঞ্জে ব্যপক সহিংসতা, অন্তত ৫ জন নিহতের সংবাদ। সারাদেশে ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭ জন আগে আহত হয়েছিলেন।
১৯ জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া সমন্বয়ক নাহিদের খোঁজ পাওয়া যায়। নাহিদ জানান, শুক্রবার রাতে তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে লোহার লাঠি দিয়ে পেটানো হয় ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে রোববার ভোরে তিনি নিজেকে পূর্বাচল জলসিঁড়ি প্রকল্প এলাকায় বড় রাস্তার পাশে আবিষ্কার করেন। বাঁ উরু, দুই বাহু আর কাঁধে জখম নিয়ে তিনি ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
কারফিউ অব্যাহত, সাধারণ ছুটির আওতায় স্বায়ত্বশাসিত, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানা-সহ সব কলকারখানা বন্ধ।
তিন বাহিনীর প্রধান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম ও মাহিন সরকার সরকারকে ৪ দফা জরুরী দাবী মেনে নেয়ার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন।
জরুরী ৪ দফা হলো:
১. ইন্টারনেট সংযোগ সচল করা,
২. শিক্ষার্থীদের আসার ব্যবস্থা করে হল খুলে দেওয়া,
৩. সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং
৪. কারফিউ তুলে দেওয়া।
একই দিনে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫৬ সমন্বয়কের যৌথ বিবৃতি’ শিরোনামে একটি খুদে বার্তা গণমাধ্যমকর্মীদের মুঠোফোনে পাঠানো হয়। যৌথ বিবৃতিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি আরও জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, শুধু আদালতের রায়ের মাধ্যমে হত্যার দায় এড়াতে পারে না সরকার। বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ‘তিন শতাধিক’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার অভিযোগ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
এ ছাড়া বিবৃতিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির কয়েকজন সমন্বয়ককে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে মনগড়া বক্তব্য আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এ ছাড়া সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদারসহ কয়েকজনের সন্ধান দাবি করা হয়েছে।
২২ জুলাই, সোমবার
কারফিউর তৃতীয় দিন। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের চতুর্থ দিন। সাধারণ ছুটি চলমান।
কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এই সময়ের মধ্যে তারা চার দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে।
সাধারণ ছুটির মেয়াদ মঙ্গলবার পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা করা হয়েছে। কারফিউও বাড়ানো হয়েছে এদিন।
বিকেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মতবিনিময়। ব্যবসায়ী নেতারা দ্ব্যর্থহীনভাবে হাসিনাকে সমর্থন জানান এবং তার পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
এদিন সংঘর্ষে আরও ১৩ জন শহীদ হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।
চার সমন্বয়কের খোঁজ পেতে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময়ের মধ্যে তাদের সন্ধান না পেলে অফিস ও বাসাবাড়ির সামনে কালো কাপড় বেঁধে মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়। এই চার সমন্বয়ক হলেন: আসিফ মাহমুদ, আবদুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার ও সহসমন্বয়ক রশিদুল ইসলাম রিফাত।
২৩ জুলাই, মঙ্গলবার
কারফিউর চতুর্থ দিন। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের পঞ্চম দিন। সাধারণ ছুটি চলমান।
কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এক সংবাদ সম্মেলন করে ৪ দফা ‘জরুরি দাবি’ পূরণে সরকারকে আরও দুদিনের আলটিমেটাম দিয়ে জানান, এই ৪ দফা পূরণ না হলে ৮ দফা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। আন্দোলনে শহীদের তালিকায় অন্তত ৮ জন পূর্বে আহত ও গুলিবিদ্ধদের নাম।
রাতে সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি অ্যাপ ব্যবহার করা যায়নি।
২৪ জুলাই, বুধবার
কারফিউর পঞ্চম দিন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল এবং বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। নিখোঁজ থাকার পাঁচ দিন পর আসিফ ও বাকেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়েছে বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দুজনই জানিয়েছেন। আর রিফাত আত্মগোপনে আছেন।
আসিফ মাহমুদ ফেসবুক পোস্টে লেখেন,
‘গত ১৯ জুলাই রাত ১১টায় আমাকে হাতিরঝিলের মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দিতে চাপ দেওয়া হয়। না মানায় ইনজেকশন দিয়ে সেন্সলেস (অচেতন) করে রাখা হয়। এই চার-পাঁচ দিনে যতবার জ্ঞান ফিরেছে, ততবার ইনজেকশন দিয়ে সেন্সলেস করে রাখা হয়। আজ বুধবার বেলা ১১টায় আবার একই জায়গায় চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে দিয়ে যায়।’
ফেসবুক পোস্টে বাকের লেখেন, ‘আমাকে ১৯ জুলাই সন্ধ্যার পর ধানমন্ডি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং আন্দোলন বন্ধে স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দিতে বলায় আমি অস্বীকৃতি জানালে একটা অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখে। যে এলাকা থেকে তুলে নেয়, তার পাশের এলাকায় আমাকে চোখ বেঁধে ফেলে যায়। আমি এখন আমার পরিবারের সঙ্গে নিরাপদে আছি। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আপনাদের সামনে সবিস্তারে সব বলব।’
রিফাত রশীদ ফেসবুকে লেখেন,‘আমি বেঁচে আছি, মরি নাই। আমি গুম হতে হতে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। সমন্বয়কদের সিদ্ধান্ত মেনেই আমি নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছিলাম। তারপর এই সাপ-লুডুর জীবন। আজ এর বাড়ি তো কাল ওর বাড়ি। এর মধ্যে যতবার ফোন কানেক্ট করার চেষ্টা করেছি, ততবারই ফোন ট্র্যাকিংয়ের শিকার হয়েছি। জানি না, কতক্ষণ নিরাপদে থাকব।
২৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রীর মেট্রোস্টেশন পরিদর্শন ও কান্না। বললেন, আমি জনগনের কাছে বিচার চাইছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জানায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই কোটা সংস্কারের যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, সেটিকে তাঁরা চূড়ান্ত সমাধান মনে করছেন না। এ ছাড়া কোটা সংস্কারের বিষয়ে সংসদে এখনো আইন পাস করা হয়নি। তাই কোটা সমস্যার এখনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলামের বক্তব্য’ শিরোনামে এক বিবৃতিতে এ কথাগুলো বলা হয়েছে। বিবৃতিটি ফেসবুকে পোস্ট করেন আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও সহসমন্বয়ক রিফাত রশীদ।
গণমামলা, ছাত্রলীগ ও পুলিশের চেকিং, গণগ্রেফতার চলমান।
২৬ জুলাই, শুক্রবার
এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ চলমান। সারা দেশে অভিযান। সারা দেশে অন্তত ৫৫৫টি মামলা। গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৬ হাজার ২৬৪।
নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই তিন তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে ডিবির হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। একদল ব্যক্তি সাদাপোশাকে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে হাসপাতাল থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে যান। সে সময় ওই ব্যক্তিরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেন।
২৭ জুলাই, শনিবার
আরো দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে তুলে নিয়ে ডিবি হেফাজতে রাখা হয়। এই দুজনকেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তথ্য জানতে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে দাবী করে ডিবি। তিন সমন্বয়কের খোঁজে ডিবি কার্যালয়ে ১২ শিক্ষক, ব্যস্ততার অজুহাতে দেখা করলেন না হারুন।
উদ্ভুত পরিস্থিতে রাতে গুগল মিটে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ৩ দফা দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনের সমন্বয়ক মো. আবদুল হান্নান মাসউদ। দাবি পূরণ না করলে সোমবার থেকে বাংলা ব্লকেড ও শাটডাউনের চেয়ে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি।
৩ দফা দাবি হলো
১. দ্রুত সময়ের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে কোটা সংস্কারের বিষয়ে এর সুপারিশ অনুযায়ী সংসদে আইন প্রণয়ন করা
২. গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের মুক্তি দেয়াসহ সব মামলা প্রত্যাহার করা এবং
৩. হত্যাকাণ্ডের’ সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা।
১১ দিনে গ্রেপ্তার ৯ হাজার ১২১ জন। এর মধ্যে রাজধানীতে গ্রেপ্তার ২ হাজার ৫৩৬ জন। পত্রিকার হিসেবে সব মিলিয়ে সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ২১০ জন। ঢাকায় কারফিউ শিথিল ১১ ঘণ্টা।
কারফিউ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে পরের তিনদিন অর্থাৎ রবিবার (২৮ জুলাই) থেকে মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত ১১ ঘণ্টা করে কারফিউ শিথিল । একই সঙ্গে এ তিনদিন বিকেল ৬টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত চলমান কারফিউ বলবৎ থাকবে। বাকি জেলাগুলোর কারফিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসনের।
২৮ জুলাই, রোববার
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়। ভোরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়।
ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়কের এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা। ডিবি কার্যালয়ে ধারণ করা ভিডিও বার্তাটি রাত নয়টার দিকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আমাদের প্রধান দাবি ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার। এটি সরকার ইতিমধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই। সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।’
সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ডিবির হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ যদি মনে করে তাঁরা ঝুঁকিমুক্ত, তখনই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
রাতে ছয় সমন্বয়কের ওই ভিডিও বার্তা আসার কিছুক্ষণ আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তাতে লেখা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই তাঁদের ডিবি কার্যালয়ে এনে কথা বললাম, কী কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁদের কথা শুনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের নানা পরিকল্পনার কথা জানানোর পর তাঁদের উদ্বেগ দূর হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টিম ডিবি, ডিএমপি বদ্ধপরিকর।’ ওই পোস্টে সংযুক্ত পাঁচটি ছবিতে হেফাজতে থাকা সাত সমন্বয়কের সঙ্গে এক টেবিলে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে খাবার খেতে দেখা গেছে।
ডিবি হেফাজতে থেকে ভিডিওবার্তায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক কর্মসূচি প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা আন্দোলনকারীদের প্রকৃত অবস্থান নয় বলে জানান তিনজন সমন্বয়ক মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের ও আব্দুল হান্নান মাসুদ। তাঁরা বলেছেন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের জিম্মি করে লিখিত বক্তব্য পাঠ করানো হয়েছে। ডিবি অফিস কখনোই ছাত্রদের সংবাদ সম্মেলনের জায়গা নয়। জোরপূর্বক আদায় করা বিবৃতি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ প্রত্যাখ্যান করছে ঘোষণা দিয়ে রিফাত রশীদ ৩ সমন্বয়কের মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি পোস্ট করেন ফেসবুকে।


মধ্যরাতে ‘সমন্বয়কদের কাছ থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি আদায়, সারা দেশে বিনা বিচারে হত্যা, গুম-খুন, মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে’ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন মুক্ত থাকা কয়েকজন সমন্বয়ক। ঢাকার আটটি স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান সমন্বয়কেরা। এই স্থানগুলো হলো সায়েন্স ল্যাব, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর গেট, জাতীয় প্রেসক্লাব, উত্তরার বিএনএস সেন্টার, মিরপুর-১০, মিরপুরের ইসিবি চত্বর, রামপুরা ও মহাখালী।
বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর বলে, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহল’ এই অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জনগণের স্বার্থে ও রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে ও থাকবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪৭ জন মারা গেছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
মোবাইল ইন্টারনেট ১০ দিন পর সচল।
২৯ জুলাই, সোমবার
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ১৪ দলের বৈঠকে।
এদিন অবিলম্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতেও আদালতের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। শুনানিতে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে খাওয়ানোর ছবি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে ‘মশকরা’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
৯ দফা ও সমন্বয়কের মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভ চলমান।
সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে পরদিন মঙ্গলবার সারা দেশে শোক পালন করার সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে।
সরকার ঘোষিত মঙ্গলবারের রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। এর বদলে আজ একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচির ঘোষণা।
৩০ জুলাই, মঙ্গলবার
লাল প্রোফাইল পিকচারে ফেসবুক সয়লাব। শোক প্রত্যাখ্যান ছাত্রজনতার।
হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান।
‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। । ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি পালন করা হবে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস এবং রাজপথে।
বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের প্রতিবাদ।
৩১ জুলাই, বুধবার
মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি। কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আদালত এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। ঢাবিতে শিক্ষকদের সংহতি। চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে ব্যাপক বিক্ষোভ।
১৩ দিন বন্ধ থাকার পর ফেসবুক–হোয়াটসঅ্যাপ চালু।
পরদিনের জন্য ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ নামে নতুন কর্মসূচী। বুধবার সন্ধ্যায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, এমন ভয়ানক অন্ধকার পরিস্থিতিতে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে, জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্র সমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি ঘোষণা করছে।’
কর্মসূচি পালনের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতগুলোর স্মৃতিচারণ, শহীদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার এবং সহপাঠীদের স্মৃতিচারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হওয়া নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে চিত্রাঙ্কন/গ্রাফিতি, দেয়াল লেখন, ফেস্টুন তৈরি, ডিজিটাল পোর্ট্রেট তৈরি প্রভৃতি।’
সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময়ের জন্য ডেকে কথা বলতে না দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি এ সময় সাবেক ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ ‘ভুয়া ভুয়া’ বলেও স্লোগান দেন।
৩২ জুলাই (১ আগস্ট), বৃহস্পতিবার
জুলাই শেষ হয়নি। আজ ৩২ জুলাই- ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এই বার্তা।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। বেলা দেড়টার একটু পরেই তাঁরা ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের একটি গাড়িতে বেরিয়ে আসেন।
রাতে ছাড়া পাওয়া অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাস। তিনি লিখেছেন, ‘ছয় দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ছয়জনকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত, সেগুলো কীভাবে নিবৃত্ত করবেন?’
সারজিস যুক্ত করেন, ‘পরিশেষে এটুকু বলতে চাই, এ পথ যেহেতু সত্যের পথ, ন্যায়ের পথ, তাই যেকোনো কিছু মোকাবিলা করতে আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। যত দিন না এ বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে, তত দিন এ লড়াই চলবে।’
গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত। ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে এসব কর্মসূচি পালনের খবর পাওয়া যায়। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কোথাও কোথাও শিক্ষক ও আইনজীবীরাও অংশ নেন। কোটা আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে রাস্তায় শিল্পীরা। চিকিৎসকদের সংহতি জানিয়ে সমাবেশ।
জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারি ।
৩৩ জুলাই (২ আগস্ট), শুক্রবার
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গ্রেপ্তারদের মুক্তি, কারফিউ প্রত্যাহার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত ‘দ্রোহ যাত্রা’ কর্মসূচিতে অংশ নেয় হাজারো মানুষ। আগেরদিন বৃহস্পতিবার রমনার মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ের সামনে এক মানববন্ধন থেকে কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়া হয়। এতে অনেক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।
জুমার নামাজ শেষে‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালন। বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ। উত্তরায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, সিলেটে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশি বাধা, হবিগঞ্জে পুলিশ-ছাত্রলীগের হামলা, নরসিংদীতে, খুলনায়, বগুড়ায় হামলা, বরিশালে সড়ক অবরোধ, চট্টগ্রামে নিউ মার্কেটে ছাত্র জনতার বিশাল সমাবেশ, এ ছাড়ার দেশের প্রায় সব জেলায় আন্দোলন ও তাতে হামলা, ও গণহত্যা অব্যাহত।
স্থগিত হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার নতুন সময়সূচী ঘোষণার পর আন্দোলনে হতাহতের ঘটনার বিচার এবং গ্রেপ্তার সহপাঠীদের মুক্তির দাবিতে চলমান এইচএসসির অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলোয় না বসার ঘোষণা দেশের অর্ধশতাধিক কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের।
গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজের সমাবেশে হাজারো জনতা। সরকারের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবী।
৪ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। ফেসবুক আবারও সাত ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছয় সমন্বয়ক জানান, ডিবি অফিসে তাদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা এদিন বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, গণভবনে তার দরজা আলোচনার জন্য খোলা রয়েছে।
৩৪ জুলাই (৩ আগস্ট), শনিবার
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা ঘোষণা। নাহিদ ইসলাম এই ঘোষণা দেন।
ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়। নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের পর আসিফ মাহমুদ অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি ঘিরে কিছু জরুরি নির্দেশনা দেন। আসিফ মাহমুদ জানান, ‘অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যেও হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, জরুরি পরিবহন সেবা (ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহন), অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহন, জরুরি ইন্টারনেট-সেবা, জরুরি ত্রাণসহায়তা ও এ খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবহন সেবা চালু থাকবে।’ আরো যোগ করেন, ‘বাংলাদেশের কোনো নাগরিক কোনো কর বা খাজনা দেবেন না। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিলসহ কোনো ধরনের বিল পরিশোধ করবেন না। সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও কলকারখানা বন্ধ থাকবে। কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না। সব ধরনের সরকারি সভা-সেমিনার ও আয়োজন বর্জন করবেন। বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোনো ধরনের পণ্য খালাস করবেন না।’


সন্ধ্যা ৭টার পর শহীদ মিনারের সমাবেশ শেষে একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে শাহবাগে এসে অবরোধ করে।
দেশের অন্যান্য অংশে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে হামলা করে পুলিশ। কুমিল্লায় ব্যাপক গোলাগুলির মুখে এক পর্যায়ে গলির বাসা-বাড়িতে আশ্রয় খুঁজতে থাকে আন্দোলনকারীরা।
নির্বাহী আদেশ ছাড়া যেকোনো উসকানির মুখেও ছাত্র ও সাধারণ জনগণের দিকে গুলি না ছুড়তে সব সেনাসদস্যদের নির্দেশ প্রদান করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
সারাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৫৮ সদস্য বিশিষ্ট সমন্বয়ক টিম গঠন।
৩৫শে জুলাই (৪ আগস্ট), রবিবার
সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু।
সারাদেশে আওয়ামী লীগের সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সহিংস সংঘর্ষ হয়। দেশব্যাপী বিক্ষোভকারী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকসহ অন্তত ১০০ জনের মৃত্যুর সংবাদ। এদিন মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। ‘শক্ত হাতে নাশকতাকারীদের প্রতিহত করার’ আহ্বান শেখ হাসিনার।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের গেট ভেঙে ভেতরে আন্দোলনকারীদের প্রবেশ, ভাঙচুর। সারদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বগুরার দুপচাচিয়া এসিল্যান্ড অফিস, গাইবান্ধা ডিসি অফিস, এসপি অফিস, ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের অফিস, রংপুরে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস, নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিস, ঈশ্বরগঞ্জে ইউএনও’র বাসা, বগুড়া সদর এসিল্যান্ড অফিস, বগুড়া ও কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আক্রমণ ও আগুন, রাজশাহীর মোহনপুর থানা, ভূমি অফিস ও আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়।
নেত্রকোনা পুলিশ স্টেশন থেকে অস্ত্র ছিনতাই করা হয়। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা, ১৩ পুলিশ নিহত। পুলিশ সদর দপ্তর বাহিনীর প্রায় ৩০০ সদস্য আহত হওয়ারও তথ্য দেয়। এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যাত্রাবাড়ী ও খিলগাঁও থানা, টাঙ্গাইলের গোড়াই হাইওয়ে থানা, বগুড়ার সদর, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানা এবং নারুলী পুলিশ ফাঁড়ি, জয়পুরহাট সদর থানা, কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, মিঠাপুকুর, পীরগাছা, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ ও গংগাচড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও আশুগঞ্জ থানা, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর থানা, হবিগঞ্জের মাধবপুর ফাঁড়ি, ময়মনসিংহ রেঞ্জ অফিস, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়, দিনাজপুর সদর থানায় আক্রমণ।
নরসিংদীতে সংঘর্ষে চেয়ারম্যান-কাউন্সিলরসহ আ.লীগের ৬ নেতা নিহত। ৪ বিচারপতির গাড়িতে হামলা। সারা দেশের সব আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
শাহবাগ, ক্যাম্পাস, সাইন্সল্যাব ছাত্রজনতার দখলে৷ জিগাতলায়, কাওরান বাজার এলাকায় সারাদিন গোলাগুলি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ৪ টা লাশ এনে রাখা হয় শহিদ মিনারে, যেগুলা আনরেজিস্ট্রার্ড। রেজিস্ট্রার্ড লাশ ছিল আরো ৩ টা। টিএসসি থেকে শাহবাগ লাশ নিয়ে ছাত্রজনতার মিছিল।
সরকারের পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনার রূপরেখা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
বিক্ষোভকারীরা সারাদেশে নাগরিকদের ‘মার্চ টু ঢাকা‘ করার আহ্বান জানান। শুরুতে ৬ জুলাই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আহ্বান জানানো হলেও পরে তা একদিন এগিয়ে এনে “পরশু নয়, আগামীকালই মার্চ টু ঢাকা” ঘোষণা দেয়া হয়। সারাদেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আহ্বান।
দুপুরের পর সারাদেশে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সহ মেটার সকল সার্ভিসসহ মোবাইল ডেটা বন্ধ।
সরাসরি গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে রিট খারিজ। সামরিক বাহিনীকে ফিরিয়ে নেইয়ার আহ্বান সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের।
সন্ধ্যা ছয়টা হতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগরসহ সকল বিভাগীয় সদর, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা সদর ও উপজেলা সদরে সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়। সোমবার থেকে আবারও তিন দিনের (৫,৬ ও ৭ আগস্ট) সাধারণ ছুটি ঘোষণা।
৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট), সোমবার
রাত থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান শুরু হয় লাখো ছাত্র-জনতার। এদিন হাজারো মানুষ কারফিউ ভেঙে ঢাকার একাধিক মোড়ে জড়ো হয়ে রাজধানীতে প্রবেশের চেষ্টা করে। ঢাকার সব প্রবেশমুখে পুলিশের শক্ত অবস্থান, বাধা।
টিভি চ্যানেলগুলোতে “কারফিউ পরিস্থিতি” দেখানো হতে থাকে, আন্দোলনের খবর নেই।
বেলা ১১টার পর থেকে ঢাকার পথে ঢল নামে মানুষের। কারফিউ ভঙ্গ করে বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেন তারা। এক পর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে।
দুপুর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপ দেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী আরও বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তাকে জানানো হয় যে, এই ধরনের ব্যবস্থা অকার্যকর হবে।
সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ছিল। সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা করে। পরে সাড়ে ৪টায় তিনি ভাষণ দেন।
দেশ ছেড়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়ন।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পর পদত্যাগ করতে রাজি হন শেখ হাসিনা। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ২টা ৩৫ মিনিটে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়ে ভারতে যান।
জনগণের দখলে গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। দেশের প্রতিটি জেলায় জনতার বাঁধভাঙা উল্লাস।
হাসিনার পলায়নের পরেও বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে শহীদ হতে থাকে ছাত্র-জনতার অনেকে।