
পৃথিবীতে দ্রুত গতির যান কোনটি?
উত্তর দেয়ার আগে ৯০ দশকের গ্রাফিতির কথা মনে পড়লো- ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’। শুনেছি, নগরীর দেয়ালে দেয়ালে আঁকা আইজুদ্দিন ছিল রিক্সাশ্রমিক। ১৯ জুলাই রামপুরা বিটিভির গেইটের সামনে বারুদেরগন্ধমাখা ধোয়ার সন্ধ্যায় আইজুদ্দিনদের সঙ্গে দেখা।
রিক্সার পাদানিতে আড়াআড়ি ঝুলে আছে একজন মানুষ। পাদানির ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ফোটার মতো ঝরছে রক্ত- লাল হয়ে যাচ্ছে পথ। অরেক সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেল চালাচ্ছে। চাকার গতির চেয়ে ঝরে পড়া রক্তের গতি বেশি। বাতাসের গতিতে রিক্সা টানতে টানতে চিৎকার করে বলছে, গুলি করেছে, রিক্সাওয়ালা। বুকের মধ্যে লেগে পিঠের দিক দিয়া বাইর হইয়া যায়। দুইজনেই রিক্সাশ্রমিক। একজন জীবন্ত, অরেকজন মৃতপ্রায়। একজনের আর্তনাদ,



অন্যজনের তখনো শ্বাস ছিল কিনা জানি না। হাসপাতালের মর্গে তার জন্য জায়গা হয়েছে কিনা জানি না। তবে দেয়ালে তাদের সঙ্গে আবার দেখা হয়। তখন শুধু দেখিছি কাঠের পা আর ঝুলে থাকা নিথর দেহ। এমন আরো অনেক পথ শিল্পের সঙ্গে কথা হয় গলির মোড় থেকে গণভবনের দেয়ালের সঙ্গে। গত ষোল বছর যে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছিল সে দেয়াল এখন ‘কথা কয়।’
জেনেছি, এই গ্রাফিতি কিংবা পথশিল্পের প্রচলন শুরু হয় গ্রিক নগরী এফেসাসেই, যেখানে গ্রাফিতি পতিতাবৃত্তির বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হতো। আর বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানে এই পথশিল্প ফিরে এসেছে হিজড়াদের বঞ্চনা কথা বলতে – ‘হিজড়া কোন গালি নয়, মানুষ আমরা পরিচয়’ ।
গ্রাফিতির জনক ফরাসি চিত্রশিল্পী ব্লেক লে রাত প্যারিসের দেয়ালে দেয়ালে এঁকেছিলেন নানা অসঙ্গতি, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ আর আশার বাণী। এসব দেয়াল ছবি দেখে নগরের মানুষরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন লড়াইয়ে, ‘সুবোধ’ এর মতো হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন। কখনো আশায় বুক বেঁধেছেন। জেন মিচেল বাস্কুইটের গ্রাফিতিও জনমনে ঝড় তুলেন। তার আঁকা একটি গ্রাফিতি ১০ কোটি ডলারে বিক্রি হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গ্রাফিতি হয়ে উঠে আরো দ্রোহী। এসময় কিলরয় এঁকেছেন – দেয়াল ধরে বসে আছেন টাকমাথার লম্বা নাকওয়ালা এক লোক । এই গ্রাফিতি জার্মান সেনাদের চিন্তিত করে তোলে। ভেবেছিল এটা আমেরিকান সেনাবাহিনীর গোপন কোড। দেশে ঘটে যাওয়া শ্রাবণ অভ্যুত্থানে গ্রাফিতিও ভয় ধরিয়ে দেয় শাসকদের। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেয়ালে এঁকে দেন – ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘দমায় রাখতে পারেনি, পারবে না’, ‘বিদ্যালাভে লোকসান, নাহি অর্থ নাহি মান, হীরক রাজা বুদ্ধিমান’, ‘রক্তের দাম চাই’। ‘আমার ভাই মরলো কেন?’ ‘দিনে আটক, রাতে নাটক’, ‘গুলি করে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’ ‘খুনি হাসিনা’। গত ৩০ জুলাই মঙ্গলবার দেয়ালে লেখা ও আঁকা মুছে ফেলা হয়। পুলিশের ভয়ে দেয়ালচিত্র আঁকা ও লেখা তরুণীরা ওই এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
১৯৬৮ সালের মে মাসে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে, তাদের সঙ্গে ফরাসি শ্রমিকরাও যোগ দেয়। বিপ্লব পায় নতুন মাত্রা। তরুণরা স্বপ্ন দেখতো রক্ষণশীল ও কড়া নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার, সমতা ফিরে পাওয়ার। অসংখ্য প্রাণ যায়। পুঁজিবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শহরের দেয়ালকে হাতিয়ার করেছেন। এঁকেছেন গ্রাফিতি। একসময় সরকারের পতন হয়। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে – বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ে, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনে, ভারতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনে, ব্রাজিলের ক্ষুধার্ত শিশুও আশ্রয় নেন দেয়ালচিত্রে। যে ঢেউ আছড়ে পড়ে বঙ্গোপসাগর কিংবা বুড়িগঙ্গার পাড়ে। দেশজুড়ে আঁকা হয় – ‘আংকেল লাগলে আবার যামু, দরকার হলে আরেকটা হাত হারামু’। ‘তুমি খাঁচায় কেনো? কারণ আমি কথা বলতে পারি।’ নগরীর দেয়ালে দেখা যায় ছাদের উপরে একটি শিশু খেলছে। মাথার উপরে হেলিকপ্টার। পাশে লেখা – খেলতে গিয়ে আর ঘরে ফিরলো না ছোট্ট শিশু রিয়া। গণতন্ত্র লিখে ‘গণে’র গলা চেপে ধরা চিত্র, কিংবা ‘একটা মানুষ মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার!’ ‘রাতের ভোট, সবখানে দুর্নীতি’ ‘আসছে ফাগুনে অলরেডি দ্বীগুন’। ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করতে যখন প্রসাশন শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক হল ছাড়ার নির্দেশ দিলে দেয়ালে দেয়ালে লিখে দেয়া হয়, ‘হল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ ‘গেরিলা বসন্তে আমরাই বুনোফুল’। ‘ছাত্র যদি ভয় পাইতো বন্দুকের গুলি, উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি’, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার ছাদে উঠব’, ‘ লোহার টুপি মানুষের মগজ খায়’ ‘হামার বেটাক মারলু কেনে?’
‘অরুণ প্রতের তরুণ দল’ দেয়ালে দেয়ালে লিখেছেন আগামীর ইশতেহার – ‘স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদা চাইলে কি করব? না বলবো, সকলে মিলে রুখে দাড়াবো, ফেইসবুক লাইভে এসে সবাইকে জানাও, কল করে সাহায্য চাইবো’ তারপর ‘ঘুষ চাইলে ঘুষি’ ‘খেটে বড় হও, চেটে নয়’।
গ্রাফিতিকে বলা হয় কাউন্টার কালচার (গতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীত)। অনুমতির ধার না ধারা শিল্প, ক্ষুরধার তীক্ষ- ফলার মতো, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাইতো এ প্রজন্মের ঘোষণা – ‘নো মোর ডার্টি পলিটিক্স’, ‘বুলেটের রাজনীতি চলবে না’, ‘বন্ধ হোক আয়নাঘর’, ‘একজন ভিআইপির জন্য পৃথিবী থামতে পারে না’, ‘যে শহরে পোষ্টার পায় ঠাই, সেই শহরে দালালের অভাব নেই’। ‘পাহাড় কবে স্বাধীন হবে’ ‘সেনাশাসন তুলে নাও’ ‘বম জাতি মুক্তি পাক, বৈষম্য মুক্তি পাক’ ‘সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদিবাসীদের জোর দাবি’ ‘তুমি কে আমি কে বাংলাদেশি’। ‘জন্মেছি এক পতাকার মাঝে এভাবে বিভেদ করো না’ ‘এক জাতির দেশ নয়, বহুজাতির বাংলাদেশ’। কিংবা লালন ও নজরুলের খোদাই করা আছে দেয়ালে – ‘মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘কেউ মালা কেউ তসবি গলে তাইতে কী জাত ভিন্ন বলে, যাওয়া কিংবা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কার রে’, ‘যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্যের ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না’।



















































































































































































এখন কেউ যদি জানতে চায় শ্রাবণঅভ্যুত্থানের অকাঙ্ক্ষা কী ছিল? উত্তর, দেয়ালের ভাষা পড়ুন। এবং দেয়ালের কথাই মনে রাখুন ‘এখনো অনেক পথ হাঁটা বাকি’ ‘আওয়াজ উঠা’ ‘কথা ক!’ ‘যা সঠিক তা করো, কণ্ঠ কাঁপলেও’।
লেখা ও গ্রাফিতির ছবি: আয়েন উদ্দীন। সাংবাদিক, দৈনিক ভোরের কাগজ